একটি দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা ও সমৃদ্ধির জন্য সুষ্ঠু প্রশাসনিক ব্যবস্থা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। প্রশাসনিক শিথিলতা নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির জন্ম নিতে পারে। প্রশাসনিক কার্যক্রমের যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন প্রশাসনের সাথে জনগণের সহযোগিতা। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিজয় অর্জন করে। স্বাধীনতার পূর্বে বাংলাদেশ ছিল পাকিস্তানের অধীনে একটি প্রদেশ। এদেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থা ছিল প্রাদেশিক। পাকিস্তান শাসনামলে এদেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থা গণমুখী হয়ে ওঠেনি। স্বাধীনতার পর ব্যাপক উন্নয়নমূলক কাজের পরিপ্রেক্ষিতে পুরাতন প্রশাসনিক ব্যবস্থা অনেকটা যুগোপযোগী হয়ে ওঠে। প্রশাসনিক ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রীয় পদ্ধতির পরিবর্তে এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। বর্তমান বাংলাদেশের প্রশাসনিক স্তরগুলো হলো: ১. কেন্দ্র, ২. বিভাগ, ৩. জেলা ও ৪. উপজেলা এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ বা অধিদপ্তর নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসন ব্যবস্থা গঠিত। শাসন সংক্রান্ত এক বা একাধিক বিভাগ একটি মন্ত্রণালয়ের ওপর ন্যস্ত। একটি মন্ত্রণালয়ের প্রধান হলেন মন্ত্রী। আর সচিব হচ্ছেন মন্ত্রণালয়ের প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা। প্রতিটি বিভাগের বা মন্ত্রণালয়ের সাথে সংযুক্ত রয়েছে বিভাগ বা অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের প্রধান হলেন মহাপরিচালক। এছাড়া এসব অধিদপ্তরের অধীনে পূর্ণ বা আধা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, বোর্ড ও কর্পোরেশন অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সরকার কর্তৃক গৃহীত আইন, নীতিমালা, কর্মসূচি কিংবা প্রকল্পের বাস্তবায়ন এসব সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। সরকারি কর্মকর্তা তথা আমলাদের প্রশাসন পরিচালনার ভিত্তি হলো সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের জ্ঞান এবং প্রশাসনিক কাজ সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ।
কেন্দ্রীয় প্রশাসন
সেক্রেটারিয়েট বা সচিবালয় বাংলাদেশ প্রশাসন ব্যবস্থার কেন্দ্রে অবস্থিত যা শাসন ব্যবস্থার স্নায়ুকেন্দ্র স্বরূপ। সরকারি যাবতীয় সিদ্ধান্ত সর্বপ্রথম সচিবালয়ে গৃহীত হয়। সাধারণত বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও তার বিভাগসমূহের অফিসগুলোকে যৌথভাবে সচিবালয় বলে। প্রধানমন্ত্রীর পছন্দানুযায়ী প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে একজন মন্ত্রী নিযুক্ত হন। মন্ত্রী হলেন একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি ও মন্ত্রণালয়ের প্রধান। মন্ত্রণালয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তথা প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন একজন সচিব। সরকারি কর্ম কমিশন কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে সেবা, যোগ্যতা, প্রশিক্ষণ এবং নির্দিষ্ট পদসোপানের মধ্য দিয়ে তিনি সচিব পদে উন্নীত হন। মন্ত্রণালয়ের যাবতীয় কাজের ভার সচিবের ওপর ন্যস্ত থাকে। তিনি মন্ত্রীকে যাবতীয় কাজে সহায়তা করেন। মন্ত্রণালয় পরিচালনার ব্যাপারে মন্ত্রী সচিবের নিকট থেকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পরামর্শ গ্রহণ করেন। সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয়ে সচিব মন্ত্রীর সহচর হিসেবে কাজ করেন। বাংলাদেশের প্রশাসনের দুইটি স্তর রয়েছে। যেমন: কেন্দ্রীয় প্রশাসন এবং মাঠ প্রশাসন। কেন্দ্রিয় প্রশাসনিক কাঠামোর পদসোপান অনুযায়ী সর্বনিম্ন স্তরের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হচ্ছেন সহকারী সচিব। ধাপের ক্রমানুসারে কর্মকর্তাদের পদবি যথাক্রমে সিনিয়র সহকারী সচিব, উপসচিব, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব, সচিব, সিনিয়র সচিব এবং সবার উপরে মন্ত্রী অবস্থান করেন। পদসোপানটি পাশে চিত্রিত হলো। প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড এই কাঠামো স্তরের মধ্য দিয়েই বাস্তবায়িত হয়। সিদ্ধান্ত বা নির্দেশ উপর থেকে নিচের দিকে যায়। সচিবের পরামর্শ ছাড়া মন্ত্রণালয়ের অধীন কোনো বিভাগীয় প্রধান, সরাসরি মন্ত্রীর কাছে কোনো প্রস্তাব বা সুপারিশ পাঠাতে পারেন না। একটি মন্ত্রণালয়ের অধীনে একাধিক সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব বা অধস্তন কর্মকর্তা থাকতে পারেন। তবে কর্মকর্তাদের সংখ্যা কতজন হবে তা মন্ত্রণালয়ের গুরুত্ব ও কার্যাবলির ব্যাপকতার ওপর নির্ভর করে।
সচিবালয়ে গৃহীত সিদ্ধান্ত ক্রমান্বয়ে বিভাগে, জেলা প্রশাসনে এবং উপজেলা প্রশাসনে প্রেরিত হয়। তাই দেখা যায় যে, সচিবালয় বাংলাদেশ প্রশাসন ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত। সকল বিভাগ, দপ্তর ও সংস্থাসমূহ সচিবালয়ের কাছে দায়ী।
বাংলাদেশে স্থানীয় প্রশাসনের গঠন ও কাজ
প্রত্যেক রাষ্ট্রে কোনো না কোনোরূপ স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে এর প্রকৃতি বা ধরন এক ও অভিন্ন নয়। একটি দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার ন্যায় এর স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাও অন্য আরেকটি দেশ থেকে ভিন্ন হয়ে থাকে। এই ভিন্নতার মূলে রয়েছে, একটি নির্দিষ্ট দেশের ভৌগোলিক অবস্থা, জাতিসত্তা, ইতিহাস-ঐতিহ্য, অভিজ্ঞতা, পরিবর্তন যারা, উৎপাদন ব্যবস্থা, রাজনৈতিক সংস্কৃতি ইত্যাদি। বাঙালি জাতি-রাষ্ট্র গঠনের মতো আমাদের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাও নানা ঐতিহাসিক পট পরিবর্তন ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছে। সময়ে সময়ে এখনও তা পুনর্বিন্যস্ত হচ্ছে।
স্থানীয় প্রশাসন
স্থানীয় শাসন বলতে সাধারণত স্থানীয় পর্যায়ের তথা বিভাগ, জেলা এবং উপজেলা শাসন ব্যবস্থাকে বুঝায়। প্রশাসনের সুবিধার্থে এর সৃষ্টি। এ প্রক্রিয়ায় কেন্দ্রীয় শাসন ও নিয়ন্ত্রণকে নিম্নস্তর পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, রাজস্ব আদায় ও সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নই এর মুখ্য উদ্দেশ্য। এ ব্যবস্থায় স্থানীয় শাসনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিকূল সরকারের এজেন্ট বা প্রতিনিধি হিসেবে গণ্য। উদাহরণ হিসেবে আমাদের দেশে বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কথা উল্লেখ করা যায়।
বিভাগীয় প্রশাসন
কেন্দ্রের পরেই বাংলাদেশে বিভাগীয় প্রশাসনের স্থান। বাংলাদেশের প্রশাসন ব্যবস্থাকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য সমগ্র দেশকে ৮টি বিভাগে বিভক্ত করা হয়েছে- ১. ঢাকা বিভাগ ২. চট্টগ্রাম বিভাগ ৩. রাজশাহী বিভাগ ৪. খুলনা বিভাগ ৫. বরিশাল বিভাগ ৬. সিলেট বিভাগ ৭. রংপুর বিভাগ ও ৮. ময়মনসিংহ বিভাগ। বিভাগীয় প্রশাসনের শীর্ষে অবস্থান করেন বিভাগীয় কমিশনার। একজন অতিরিক্ত কমিশনার এবং কমিশনারের ব্যক্তিগত সহকারীসহ বহুসংখ্যক কর্মচারী বিভাগীয় প্রশাসনে কর্মরত থাকেন।
বিভাগীয় কমিশনার বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের একজন পদস্থ কর্মকর্তা। তিনি একজন যুগ্ম সচিব পদমর্যাদাসম্পন্ন কর্মকর্তা। তিনি মূলত বাংলাদেশ সরকারের রাজ্য বিষয়ক কর্মকর্তা। বিভাগীয় কমিশনার জেলা প্রশাসকদের কার্যাবলি তদারকি করেন। তিনি বিভাগীয় প্রশাসন ও জেলা প্রশাসনের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেন। বিভাগের জনকল্যাণমূলক কাজের পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন তাঁর দায়িত্ব। সাহায্য ও সেবামূলক কাজ, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ব্যবস্থা গ্রহণ ইত্যাদিও তাঁকে করতে হয়। বস্তুত তিনি বিভাগ পর্যায়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন।
জেলা প্রশাসন
জেলা প্রশাসন বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামোর তৃতীয় স্তর। প্রত্যেক বিভাগ কয়েকটি জেলায় বিভক্ত। বর্তমানে বাংলাদেশে ৬৪টি জেলা রয়েছে। জেলা প্রশাসককে কেন্দ্র করে জেলার সমগ্র শাসন আবর্তিত হয়। জেলা প্রশাসক বা ডেপুটি কমিশনার হলেন জেলা প্রশাসনের মধ্যমণি। তিনি বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের একজন অভিজ্ঞ সদস্য। তিনি প্রশাসনের উপসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা। বিভাগীয় কমিশনারের পরই তাঁর স্থান। জেলা প্রশাসনের সঙ্গে কেন্দ্রের যোগসূত্র বিদ্যমান। বাংলাদেশ সচিবালয়ে জেলা-সংক্রান্ত গৃহীত যাবতীয় সিদ্ধান্ত সরাসরি জেলা প্রশাসকের নিকট প্রেরিত হয়। জেলা প্রশাসক কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত মোতাবেক জেলা প্রশাসন পরিচালনা করেন। আর জেলা প্রশাসকদের কেন্দ্র করেই জেলার প্রশাসন পরিচালিত ও আবর্তিত। জেলা প্রশাসক তাঁর কাজের জন্যবিভাগীয় কমিশনারের কাছে দায়ী। বিভাগীয় কমিশনার আবার যাবতীয় কার্যাবলির জন্য কেন্দ্রের নিকট দায়ী। বিভাগীয় কমিশনারের মাধ্যমে জেলা ও কেন্দ্রের মধ্যে সেতুবন্ধন সৃষ্টি হয়। জেলা প্রশাসকের কার্যাবলি ব্যাপক।
জেলা প্রশাসকের কার্যাবলি
জেলা প্রশাসকদের কার্যাবলি ব্যাপক ও বহুমুখী। নিম্নে তা সংক্ষেপে আলোচিত হলো :
১. প্রশাসন সংক্রান্ত কাজ : বাংলাদেশ সচিবালয়ে গৃহীত শাসন সংক্রান্ত সকল সিদ্ধান্ত ও নীতিমালা বাস্তবায়ন করা, বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কাজ তদারক করা, সরকারি নীতি নির্ধারণ এবং সুষ্ঠুভাবে শাসনকার্য পরিচালনায় সরকারকে সর্বাত্মক সাহায্য সহযোগিতা করা জেলা প্রশাসনের শাসন সংক্রান্ত কাজ।
২. রাজস্ব সংক্রান্ত কাজ জেলা প্রশাসক ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টর হিসেবে জেলার ভূমি রাজস্ব ও অন্যান্য কর ধার্য ও আদায় করেন। এ সকল কাজে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) তাঁকে সাহায্য করেন।
৩. সমন্বয় সংক্রান্ত কাজ সমন্বয় সাধন সংক্রান্ত বিষয়ে জেলা প্রশাসকের ভূমিকা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তিনি জেলার অভ্যন্তরে অবস্থিত সরকারি সকল দপ্তরের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করেন। জেলা প্রশাসক জেলার উন্নয়নের জন্য জেলার গণ্যমান্য লোকদের সাথে এলাকার বিভিন্ন সমস্যা ও সেসবের সমাধানের লক্ষ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন।
৪. স্থানীয় শাসন সংক্রান্ত কাজ স্থানীয় শাসন সংক্রান্ত বিষয়ে জেলা প্রশাসকের ভূমিকা অপরিসীম। তিনি স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেখাশুনা করেন। জেলার আওতাধীন উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদের ক্ষেত্রে তিনি তত্ত্বাবধায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।
৫. সেবামূলক কাজ ডেপুটি কমিশনার বা জেলা প্রশাসক মানব সেবামূলক কাজও করে থাকেন। তিনি জেলার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিলে জনগণের জন্য সেবামূলক কাজের যারা তাদের দুঃখ-দুর্দশা দূর করতে সচেষ্ট হন। এসময় কেন্দ্রীয়ভাবে বরাদ্দকৃত অর্থ, খাদ্য, বস্ত্র ও ঔষধ জেলার জনগণের মধ্যে বিতরণ করেন।
৬. শিক্ষা ও সংস্কৃতি সংক্রান্ত কাজ জেলার শিক্ষা বিষয়ক সকল প্রকার কর্মসূচির তত্ত্বাবধান এবং জাতীয় দিবসসমূহ উদযাপন ও বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড জেলা প্রশাসক পরিচালনা করেন।
৭. শান্তি রক্ষামূলক কাজ : জেলার পুলিশ সুপারের সহযোগিতায় নিজ জেলায় শান্তি প্রতিষ্ঠা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করেন।
৮. বিবিধ জেলা প্রশাসক জেলার প্রধান কর্মকর্তা হিসেবে বহুবিধ দায়-দায়িত্ব পালন করেন। তিনি জেলার প্রকাশনা ও সংবাদপত্র বিভাগের প্রধান নিয়ন্ত্রক। তিনি জনকল্যাণমূলক কাজের জন্য বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ান। আগ্নেয়াস্ত্র, স্পিরিট ও বিষ প্রভৃতির লাইসেন্স প্রদানের দায়িত্ব তাঁর উপরই ন্যস্ত। জেলা প্রশাসক জেলার প্রতিরোধমূলক বিচারকার্য সম্পন্ন করেন। তিনি জেলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা সংশ্লিষ্ট কাজ পরিচালনা, তত্ত্বাবধান ও সমন্বয় করে থাকেন। কাজেই জেলা প্রশাসককে জেলার পরিচালক, তত্ত্বাবধায়ক ও নিয়ন্ত্রক বলা চলে।
উপজেলা প্রশাসন
উপজেলা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক স্তর। প্রতিটি জেলা কয়েকটি উপজেলায় বিভক্ত। বর্তমানে দেশে ৪৯২টি উপজেলা রয়েছে। উপজেলার প্রশাসনিক কর্মকর্তা হলেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার। তিনি জেলা প্রশাসকের আদেশ বাস্তবায়ন এবং উপজেলার অন্যান্য কাজের সমন্বয় করে থাকেন। তিনি বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের একজন সদস্য। উপজেলা পর্যায়ের অন্যান্য কর্মকর্তাদের সহায়তায় উপজেলার সকল উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেন। এছাড়া উপজেলার শাসন ব্যবস্থা ও শান্তি-শৃঙ্খলার কাজও তিনি দেখাশুনা করেন। মূলত উপজেলার সকল উন্নয়ন ও প্রশাসনিক কাজ তদারক করা তাঁর দায়িত্ব ।
স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন
স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন বলতে নির্দিষ্ট এলাকাভিত্তিক জনগণের স্বশাসনকে বুঝায়। সংশ্লিষ্ট এলাকার জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা তা পরিচালিত হয়। প্রতিনিধিরা তাঁদের কাজের জন্য জনগণের নিকট দায়ী থাকেন। স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো- ক. আইনগত ভিত্তি খ. নির্বাচিত সংস্থা, গ. সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ, ঘ. করারোপের মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহের ক্ষমতা ও পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, চ. কেন্দ্রীয় বা বিভাগীয় প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণমুক্ত থেকে স্বাধীনভাবে কার্য পরিচালনা প্রভৃতি। এটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা বা সরকার পরিচালনা পদ্ধতির পরিশীলিত রূপ। বাংলাদেশের স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন, পার্বত্য জেলা পরিষদ প্রভৃতি।
ইউনিয়ন পরিষদ
ইউনিয়ন পরিষদ এদেশের সর্বাপেক্ষা প্রাচীন স্থানীয় প্রতিষ্ঠান। ব্রিটিশপূর্ব আমল থেকে বর্তমান পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির অগ্রযাত্রা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, গ্রাম এলাকায় জনপ্রতিনিধিত্বমূলক স্থানীয় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এটি কাজ করছে। ব্রিটিশ আমলে গ্রাম এলাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সহযোগিতা করার জন্য চৌকিদারি পঞ্চায়েত আইন ১৮৭০ প্রবর্তিত হয়। পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে গ্রামে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা ও বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজ পরিচালনা করার জন্য এ ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। ১৮৮৫ সালে স্থানীয় পর্যায়ে অধিক দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গীয় স্থানীয় আইন পাস হয়। এই আইনে ইউনিয়ন পর্যায়ে ইউনিয়ন কমিটি, মহকুমা পর্যায়ে মহকুমা বোর্ড ও জেলা পর্যায়ে জেলা বোর্ড গঠন করা হয়। ১৯১৯ সালের পল্লী আইনে চৌকিদারি পঞ্চায়েত ও ইউনিয়ন কমিটি বিলুপ্ত করে ইউনিয়ন বোর্ড নামে একটিমাত্র স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়। পাকিস্তান আমলে এর নাম হয় ইউনিয়ন কাউন্সিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৬ সালে স্থানীয় সরকার অধ্যাদেশে ইউনিয়ন পরিষদ, থানা পরিষদ ও জেলা পরিষদ - এই তিন স্তর বিশিষ্ট স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা চালু করা হয়। ১৯৯৭ সালে স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) সংশোধিত আইনের মাধ্যমে ইউনিয়ন পরিষদ গঠনে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়। সাধারণত গড়ে ১০-১৫টি গ্রাম নিয়ে একটি ইউনিয়ন পরিষদ গঠিত। ইউনিয়ন পরিষদে একজন নির্বাচিত চেয়ারম্যান, নয় জন নির্বাচিত সাধারণ সদস্য ও তিন জন নির্বাচিত মহিলা সদস্য (সংরক্ষিত আসনে) থাকবেন। পূর্বে একটি ইউনিয়ন তিনটি ওয়ার্ডে বিভক্ত ছিল। সংশোধিত আইনে ওয়ার্ড সংখ্যা ৯ (নয়) টিতে উন্নীত করা হয়েছে। প্রত্যেক ওয়ার্ড থেকে একজন করে মোট নয়জন সাধারণ সদস্য জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হবেন। প্রতি৩ ওয়ার্ডে একজন মহিলা সদস্য পুরুষ ও মহিলা সকলের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন। ইউনিয়ন পরিষদের কার্যকাল ৫ বছর। বাংলাদেশে সর্বমোট ৪,৫৭১ টি ইউনিয়ন পরিষদ রয়েছে।
ইউনিয়ন পরিষদের কার্যাবলি
ইউনিয়ন পরিষদের কার্যাবলিকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে, যথা: ১. প্রধান কার্যাবলি ও ২. ঐচ্ছিক কার্যাবলি।
প্রধান কার্যাবলি
১. জনশৃঙ্খলা রক্ষা : গ্রামে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা ইউনিয়ন পরিষদের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনের জন্য প্রতিটি ইউনিয়নে কিছু চৌকিদার ও দফাদার নিয়োগ করা অপরাধ, বিশৃঙ্খলা ও চোরাচালান বন্ধের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ; ঝগড়া-বিবাদ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা নিরসনে ভূমিকা পালন; গ্রাম আদালত সম্পর্কিত দায়িত্ব সম্পাদন। পারিবারিক বিরোধের আপোস-মীমাংসার উদ্যোগ গ্রহণ ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ইউনিয়ন পরিষদ পালন করে।
২. জনকল্যাণমূলক কাজ ও সেবা : ইউনিয়নে অবস্থিত কৃষি, স্বাস্থ্য, মৎস্য, পশুপালন ও শিক্ষা বিষয়ক বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি সংস্থার সেবা ও কার্যক্রম জনগণকে অবহিতকরণ এবং গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্থার কর্মসূচির অধীনে প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, স্যানিটেশন, পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন, আত্মকর্মসংস্থান ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নমূলক কার্যক্রম পরিচালনা ইউনিয়ন পরিষদের প্রধানতম কার্যাবলির মধ্যে পড়ে।
৩. স্থানীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্পর্কিত পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন এলাকার কৃষি উন্নয়নের জন্য যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ, গ্রামীণ শিল্পের উন্নয়ন সাধন, বাজার সৃষ্টি, মৎস্য চাষ ও পশু পালনের উন্নত পদ্ধতি সম্পর্কে জনসাধারণকে অবহিতকরণ, উন্নত বীজ, চারা ও সার বিতরণের সুষ্ঠু ব্যবস্থা সৃষ্টি করা, জনগণের আয় বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রমে পরামর্শ প্রদান, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বাঁধ নির্মাণ প্রভৃতি।
৪. প্রশাসনিক কাজ ইউনিয়ন পরিষদের সচিব, গ্রাম পুলিশ ও পরিষদের অন্যান্য কর্মচারীদের পরিচালনা, তদারকি
ও নিয়ন্ত্রণ করা, সকল সভা আহ্বান, বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রণয়ন ও প্রেরণ করা, কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব পালন ইত্যাদিও ইউনিয়ন পরিষদ করে থাকে।
ঐচ্ছিক কার্যাবলি
জনপথ ও রাজপথের ব্যবস্থা এবং রক্ষণাবেক্ষণ করা বিধবা, এতিম, গরিব ও দুস্থ ব্যক্তিদের সাহায্যকরণ। প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্রের ব্যবস্থাকরণ। প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার তদারকি এবং ঘরে ঘরে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়া পরিবেশ সরক্ষণ ও বনায়ন ইউনিয়নের পরিচ্ছন্নতা রক্ষা, পাঠাগার স্থাপন, উদ্যান ও খেলার মাঠের ব্যবস্থা, গণসংযোগ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণকার্য সম্পাদন দুস্থ ব্যক্তির তালিকা প্রণয়ন। সকল প্রকার শুমারি পরিচালনার দায়িত্ব পালন; সরকারি সম্পত্তি, যেমন- সড়ক, সেতু, খাল, বাঁধ, টেলিফোন ও বিদ্যুৎ লাইন রক্ষণাবেক্ষণ, পল্লি বিদ্যুতায়নের উদ্যোগ গ্রহণ ইত্যাদি ইউনিয়ন পরিষদের ঐচ্ছিক কাজের অন্তর্গত।
উপজেলা পরিষদ
বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার এটি গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট উপজেলা পরিষদ। দেশের ৬৪টি জেলার ৪৯২টি উপজেলায় স্থানীয় জনগণের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য নির্বাচনের মাধ্যমে উপজেলা পরিষদ গঠনেরবিধান রয়েছে। উপজেলা ব্যবস্থা ১৯৮৩ সালে প্রথম প্রবর্তন করা হয়। কিন্তু এ ব্যবস্থাটি বিভিন্ন কারণে পরবর্তীতে সময়ে স্থায়ীরূপ লাভ করেনি। এ লক্ষ্যে উপজেলা পরিষদ আইন, ১৯৯৮ পুনঃপ্রচলন এবং উক্ত আইনের অধিকতর সংশোধনকল্পে ৬ এপ্রিল ২০০১ সালে উপজেলা পরিষদ আইন পাস হয়। এ আইন 'উপজেলা পরিষদ (রহিত আইন পুনঃপ্রচলন ও সংশোধন) আইন ২০০৯' নামে পরিচিত।
আইনের বিধান অনুযায়ী নিম্নোক্তদের সমন্বয়ে উপজেলা পরিষদ গঠিত হবে :
ক. চেয়ারম্যান
খ. ২ জন ভাইস চেয়ারম্যান ( যার মধ্যে একজন নারী)
গ. উপজেলার এলাকাভুক্ত প্রত্যেক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান
ঘ. উপজেলার এলাকাভুক্ত পৌরসভার মেয়র ও
৫. সংরক্ষিত আসনে নির্বাচিত নারী সদস্যগণ।
চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান জনগণের ভোটে সরাসরি নির্বাচিত হবেন। উপজেলার এলাকাভুক্ত ইউনিয়ন পরিষদ সমূহ ও পৌরসভার মোট সদস্য সংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের সমসংখ্যক আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে, যারা উক্ত উপজেলার এলাকাভুক্ত ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভার সংরক্ষিত আসনের নারী সদস্য বা কাউন্সিলরগণ কর্তৃক তাদের মধ্য হতেই নির্বাচিত হবেন। উপজেলা পরিষদ এলাকার সার্বিক উন্নয়নে কাজ করবে। সকল কাজের সফলতা নির্ভর করবে জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে।
জেলা পরিষদের গঠন প্রণালি
বাংলাদেশ সরকার ৬ জুলাই ২০০০ সালে জেলা পরিষদ আইন ২০০০' প্রবর্তন করে। আইনের বিধান অনুযায়ী খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা ও বান্দরবান পার্বত্য জেলাসমূহ ব্যতীত অন্য জেলায় জেলা পরিষদ গঠনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। একজন চেয়ারম্যান, পনেরো জন সদস্য এবং সংরক্ষিত আসনের পাঁচজন নারী সদস্য নিয়ে জেলা পরিষদ গঠিত। একটি জেলা পরিষদের মেয়াদ বা কার্যকাল থাকবে পাঁচ বছর।
জেলা পরিষদের কার্যাবলি
জেলা পরিষদের কার্যাবলি দুই ধরনের, যথা: আবশ্যিক ও ঐচ্ছিক।
আবশ্যিক কার্যাবলি
১. জেলার সকল উন্নয়ন কার্যক্রমের পর্যালোচনা
২. উপজেলা পরিষদ ও পৌরসভা কর্তৃক প্রকল্পসমূহের বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা
৩. সাধারণ পাঠাগারের ব্যবস্থা ও রক্ষণাবেক্ষণ,
৪. জনপথ, কালভার্ট ও ব্রিজ নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ এবং উন্নয়ন;
৫. রাস্তার পাশে বৃক্ষরোপণ ও সংরক্ষণ
৬. উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নকারী অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সহযোগিতা
৭. উপজেলা ও পৌরসভাকে সহায়তা, সহযোগিতা এবং উৎসাহ প্রদান ৮. সরকার কর্তৃক জেলা পরিষদের ওপর অর্পিত উন্নয়ন পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ও
৯. সরকার কর্তৃক আরোপিত অন্যান্য কাজ।
ঐচ্ছিক কার্যাবলি
জেলা পরিষদ ঐচ্ছিক কার্যাবলির অংশ হিসেবে শিক্ষা, সংস্কৃতি, সমাজকল্যাণ, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, জনস্বাস্থ্য ও গণপূর্ত বিষয়ক বিস্তৃত কার্যক্রম গ্রহণ করে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অর্থ মঞ্জুরি প্রদান ও শিক্ষার উন্নয়নের সহায়ক অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণ। জনসাধারণের জন্য ক্রীড়া ও খেলাধূলা কার্যক্রমের উন্নয়ন। তথ্যকেন্দ্র স্থাপন; জাতীয় দিবস উদযাপন: নাগরিক শিক্ষার প্রসার। দুস্থ ব্যক্তিদের জন্য কল্যাণকর আশ্রয় সদন, , বিধবা সদন, এতিমখানা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান স্থাপন; জুয়া, মাদকদ্রব্য সেবন, কিশোর অপরাধ ও অন্যান্য সামাজিক অনাচার ও বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ; সালিশী ও আপোসের মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা গ্রহণ; অর্থনৈতিক উন্নয়নে আদর্শ কৃষি খামার স্থাপন, উন্নত কৃষি পদ্ধতি জনপ্রিয়করণ, কৃষি যন্ত্রপাতির সংরক্ষণ ও সরবরাহ, পতিত জমি চাষের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ, বাঁধ নির্মাণ ও মেরামত সেচের পানি সরবরাহ, জমানো ও নিয়ন্ত্রণ; বনভূমি সংরক্ষণ, গ্রামাঞ্চলের শিল্পসমূহের জন্য কাঁচামাল সংগ্রহ এবং উৎপাদিত সামগ্রীর বাজারজাতকরণ, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি সাধন, পানি নিষ্কাশন ও অন্যান্য জনহিতকর কাজ জেলা পরিষদের ঐচ্ছিক কার্যাবলির অন্তর্ভুক্ত। এভাবে জেলা পরিষদ স্থানীয় এলাকাবাসীর ধর্মীয়, নৈতিক ও বৈষয়িক উন্নতি সাধনের জন্য কাজ করে।
পৌরসভা
শহর এলাকার স্থানীয় শাসন সংস্থাটির নাম পৌরসভা। বাংলাদেশে প্রত্যেক পৌর বা শহর এলাকার জন্য একটি করে পৌরসভা আছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ছোট বড় মোট ৩৩০টি পৌরসভা রয়েছে। প্রাপ্তবয়স্কদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত একজন মেয়র এবং ওয়ার্ডভিত্তিক নির্বাচিত সদস্য নিয়ে পৌরসভা গঠিত হয়। সদস্যগণ কাউন্সিলর নামে পরিচিত। দেশের সকল পৌরসভার সদস্য সংখ্যা সমান নয়। পৌর এলাকার আয়তন ও জনসংখ্যার ভিত্তিতে সদস্য সংখ্যা কমবেশি হতে পারে। পৌরসভার কার্যকাল পাঁচ বছর।
কার্যাবলি
পৌরসভা শহর এলাকার বিভিন্ন সমস্যার সমাধান ও উন্নয়নকল্পে বহুবিধ কাজ করে থাকে। যেমন:
১. পরিকল্পনামূলক শহর ও এর অন্তর্গত এলাকার সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য পৌরসভা বিভিন্ন প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করে। শহর এলাকার সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য সড়ক বা মহাসড়ক ও আবাসিক এলাকার বিন্যাস পৌরসভার কাজ।
জননিরাপত্তামূলক : পৌরসভা অগ্নিনিরোধ ও নির্বাপণের ব্যবস্থা করে থাকে। বন্যা, মহামারি, দুর্ভিক্ষ, ঘূর্ণিঝড়
ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে জনজীবন রক্ষা সংক্রান্ত কাজও করে। ৩. জনস্বাস্থ্য বিষয়ক পৌরসভা সরকারি রাস্তা, পায়খানা, ডাস্টবিন, পয়ঃপ্রণালির, ময়লা ও আবর্জনা অপসারণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করে। তাছাড়া চিকিৎসা কেন্দ্র একটি তালিকা প্রস্তুত কর মাতৃসদন, শিশু সদন ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা, সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকার, দূষিত ও ভেজাল খাদ্য ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ করা, বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করা ইত্যাদি পৌরসভার জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত ককাজ।
৪. বাসস্থান সংক্রান্ত : পৌর এলাকার গৃহ নির্মাণ ও সংস্কারে পৌরসভার অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। পৌরসভা দালানকোঠা, বাড়িঘর নির্মাণের নকশা ও পরিকল্পনার অনুমোদন দেয়।
৫. শিক্ষা সংক্রান্ত : পৌরসভার শিক্ষা সংক্রান্ত কার্যাবলি হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হোস্টেল নির্মাণ, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান, দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি, বিনামূল্যে বই বিতরণ, বাধ্যতামূলক ও গণশিক্ষার ব্যবস্থাকরণ ইত্যাদি।
৬. রাস্তাঘাটের উন্নয়ন জনসাধারণের চলাচলের সুবিধার জন্য পৌরসভা রাস্তা নির্মাণ, নামকরণ ও সংরক্ষণ করে। রাস্তাঘাট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, রাস্তায় আলোর ব্যবস্থা করা এবং রাস্তায় যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা পৌরসভার কাজ।
৭. সমাজকল্যাণ সংক্রান্ত পৌরসভা অনাথ, গরিব-দুঃখী ও দুস্থদের জন্য কল্যাণকেন্দ্র এবং এতিমখানা স্থাপন ও পরিচালনা করে থাকে।
৮. বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি : পৌর এলাকার বন সংরক্ষণ ও উন্নয়ন, রাস্তার পাশে ও সরকারি জায়গায় বৃক্ষরোপণ ও সংরক্ষণ, জনসাধারণের চিত্তবিনোদনের জন্য পার্ক, উদ্যান ও উন্মুক্ত প্রাভাণ নির্মাণ ও সংরক্ষণ এবং খেলার মাঠের ব্যবস্থা করাও পৌরসভার দায়িত্ব।
১. সালিশি কার্যক্রম পরিচালনা পৌরসভায় বসবাসরত জনসাধারণের জরিমানা সংক্রান্ত সমস্যা, সীমানা নির্ধারণ,পারিবারিক সমস্যা ও ঝগড়া বিবাদ মীমাংসা করার জন্য পৌরসভা সালিশি উদ্যোগ নিতে ও মধ্যস্থতা করতে পারে। এক্ষেত্রে ওয়ার্ড কমিশনার এবং প্রয়োজনে চেয়ারম্যান মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভূমিকা রাখেন। জেলা ও উপজেলা শহর এলাকার উন্নয়নে পৌরসভা একটি গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকরী স্থানীয় শাসন সংস্থা যা জনগণের সমস্যা সমাধানে ও অংশগ্রহণের মাধ্যমে কাজ করছে।
সিটি কর্পোরেশন
ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট, বরিশাল, রংপুর, কুমিল্লা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও ময়মনসিংহ পৌরসভাকে সিটি কর্পোরেশনে রূপান্তর করা হয়েছে। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনকে আইনের মাধ্যমে ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ নামে দুটি কর্পোরেশন হিসেবে বিভক্ত করা হয়েছে। বর্তমানে দেশে ১২টি সিটি কর্পোরেশন রয়েছে। সিটি কর্পোরেশনের এলাকা ও কাজের ওপর এর সদস্যসংখ্যা নির্ভর করে। কর্পোরেশনে একজন মেয়র আছেন। তাঁরা জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন। শহরের নানাবিধ সমস্যা, যেমন- পানীয় জলের ব্যবস্থা, পয়ঃনিষ্কাশন, ময়লা-আবর্জনা অপসারণ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, নাগরিক সুবিধা বৃদ্ধি এবং সার্বিক উন্নয়নের জন্য সিটি কর্পোরেশন গঠন করা হয়েছে। স্থানীয় শাসনের মতো স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোও একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণের জীবনধারা উন্নত করার জন্য অপরিহার্য।
স্থানীয় স্বায়ত্বশাসনের গুরুত্ব
আধুনিককালে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের গুরুত্ব যে কত বেশি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বর্তমানে রাষ্ট্রের আয়তন ও জনসংখ্যা বিশাল। রাজধানীতে বসে কেন্দ্রীয় কাজ সরকারের একার পক্ষে দেশের সর্বত্র সুষ্ঠুভাবে শাসনকার্য পরিচালনা, নানা দলগত স্থানীয় প্রশাসনের গুরুত্ব নিয়ে বিষয়ে দৈনন্দিন নজর রাখা, স্থানীয় সমস্যা সমাধানে কার্যকর ও সঠিক সময়ে একটি বিতর্কমূলক আলোচনা কর। পদক্ষেপ গ্রহণ, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ত্বরান্বিত ও অঞ্চল নির্বিশেষে সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। স্থানীয় শাসন ব্যবস্থা দ্বারা তা সহজসাধ্য হয়। স্থানীয় শাসনের শ্রেষ্ঠত্ব হলো এটি কেন্দ্রের মুখাপেক্ষিতা এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা মুক্ত। এ ব্যবস্থায় স্থানীয়পর্যায়ে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান ও স্থানীয় উন্নয়নে ত্বরিত উদ্যোগ ও পদক্ষেপ গ্রহণ সম্ভব হয়। এ ব্যবস্থা স্থানীয় শাসন ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে জনগণের অংশগ্রহণ, সচেতনতা বৃদ্ধি ও নেতৃত্ব সৃষ্টি করে। প্রশাসনের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়। ফলে গণতন্ত্রের ভিত সুদৃঢ় হয়। রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থা হয় উন্নত।